আকিকা দেওয়ার নিয়ম ও বিধি-বিধান

আকিকা করা সুন্নত। নবজাতক শিশু ছেলে হোক কিংবা মেয়ে হোক, আকিকা করতে হবে। আকিকা দেওয়ার নিয়ম ও বিধি-বিধান মেনে আকিকার কাজ সম্পন্ন করতে হবে। সন্তান জন্মের সপ্তম দিন পিতা-মাতার উচিত সন্তান জন্মের শুকরিয়া আদায় করার লক্ষে যেকোনো পশু জবাই করে সন্তানের আকিকা করা, মাথার চুল কামানো এবং সন্তানের জন্য সুন্দর ইসলামিক নাম রাখা। আজকের এই পোস্টে আপনাদের সাথে আকিকা করার নিয়ম এবং বিধি-বিধান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। তো চলুন, শুরু করা যাক।

আকিকা দেওয়ার নিয়ম

আকিকা দেওয়ার নিয়ম
আকিকা দেওয়ার নিয়ম

আকিকা দেওয়ার নিয়ম এবং বিধি-বিধান রয়েছে। এই বিধি-বিধান মেনে সন্তানের আকিকা দিতে হবে। ছেলেদের আকিকা দেওয়ার নিয়ম এবং মেয়েদের আকিকা দেওয়ার নিয়ম এর মাঝে অল্প একটু পার্থক্য রয়েছে। ছেলেদের আকিকা দেয়ার সময় দুইটি পশু এবং মেয়েদের আকিকা দেয়ার সময় একটি পশু কুরবানি করতে হবে। আকিকার পশু এবং সংখ্যা নিয়ে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সেখানে থেকে বিস্তারিত জেনে নিতে পারবেন। এছাড়াও, আকিকার সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ, আকিকা করার নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। সম্ভব হলে এ সময়ের মাঝেই আকিকা করতে হবে। বিস্তারিত নিচে বর্ণনা করেছি।

আকিকার সময়

আকিকা করা প্রতিটি শিশুর অধিকার। সন্তান জন্মের সপ্তম দিনে আকিকা করতে হবে। যদি কোনো কারণ বশত সপ্তম দিনে আকিকা করা সম্ভব না হয় তবে ১৪তম দিনে আকিকা সম্পন্ন করতে হবে। তবু যদি কোনো সমস্যার কারণে ১৪তম দিনে আকিকা করা সম্ভব না হয়, তবে ২১তম দিনে আকিকা করতে হবে। এরপরও যদি আকিকা করা সম্ভব না হয়, তবে যেকোনো একদিন আকিকা সম্পন্ন করতে হবে। একজন শিশু জন্ম নেয়ার পর তার আকিকা করা আবশ্যক। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে আকিকা করেছেন।

মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আকিকা সমন্ধে বলেছেন, ‘প্রত্যেক শিশু তার আকিকার বিনিময়ে বন্ধকস্বরূপ। কাজেই সপ্তম দিনে তার পক্ষ থেকে জবাই করবে এবং তারা মাথা মুণ্ডন করে নাম রাখবে’ (সুনানে আবু দাউদ : ২/৩৯২)। 

আকিকার পশু ও সংখ্যা

আকিকা করার সময় অবশ্যই এক বা একাধিক পশু কুরবানি করতে হবে। অনেকেই প্রশ্ন করে থাকেন, আকিকা করার সময় কতটি পশু বা কোন পশু কুরবানি করতে হবে? আকিকা দেওয়ার নিয়ম অনুযায়ী উট, গরু, মহিষ, ভেড়া বা ছাগল দিয়ে আকিকা করতে হবে। কোরবানির পশুর মতো আকিকার পশু সুস্থ, সবল ও ত্রুটিমুক্ত হতে হয়। আকিকা সম্পর্কে হযরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে ছেলে সন্তানের জন্য দুটি সমবয়সী ছাগল আর মেয়ে সন্তানের জন্য একটি ছাগল দিয়ে আকিকা করার জন্য নির্দেশ করেছেন। (তিরমিজি শরিফ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৮৩; আবু দাউদ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৪)।

হজরত উম্মে কুরজ রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, ‘নবজাতক সন্তান ছেলে হলে দু’টি ছাগল আর মেয়ে হলে একটি ছাগল দিয়ে আকিকা করবে’ (তিরমিজি শরিফ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৮৩; আবু দাউদ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৪)। 

আরও পড়ুন – কোরবানির দোয়া ও নিয়ত

যদি ছেলে সন্তান এর আকিকা দেয়ার সময় দুইটি পশু কুরবানি করা সম্ভব না হয়, তবে একটি পশু কুরবানি করেও আকিকা দেয়া যাবে। আর্থিক অসুবিধা হলে একটি ছাগল দিয়েও আকিকা করা জায়েজ আছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর থেকে প্রমাণিত, ছেলেদের আকিকার সময় একটি দুম্বা দিয়েও আকিকার কাজ সম্পন্ন করা হয়েছিলো।

আকিকার মাংস বিতরণ

কুরবানির মাংসের মতো করে আকিকার মাংস ৩ভাগে করে বিতরণ করা যাবে। আকিকার গোশত রান্না করা হলে আত্মীয়-স্বজন এবং গরিব-মিসকিনের মাঝে বিতরন করা যাবে। আকিকার গোশত সচ্ছল আত্মীয়-স্বজনের কাছেও বন্টন করে দেয়া যাবে। আকিকার পশুর গোশত তিন ভাগ করে এক-তৃতীয়াংশ নিজের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ গরিব-মিসকিনদের জন্য সাদকা করে দিয়ে বাকি এক-তৃতীয়াংশ আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া সুন্নত।

সন্তানের পিতা-মাতা নিজেরা এবং পরিবারের সবাই আকিকা করার সময় কুরবানি করা পশুর মাংস খেতে পারবে। এক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, আকিকার গোশত নিজে খাবে, অন্যকে খাওয়াবে এবং কিছু সদকা করবে। (মুসতাদরাকে হাকেম, হাদিস: ৭৬৬৯)

কুরবানির সাথে আকিকা দেয়ার নিয়ম

অনেকেই কুরবানির সাথে আকিকা দিতে চায়। কুরবানির সময় একটি পশুতে সাতজন মিলে অংশিদার হয়ে কুরবানি করতে পারে। অনেকেই কুরবানির সাথে একই পশু দিয়ে আকিকা করতে চায়। কিন্তু, কুরবানির সাথে আকিকা দেয়ার কোনো নিয়ম নেই। আকিকা দিতে হলে আলাদা পশু কুরবানি করে দিতে হবে। কুরবানি এবং আকিকা একসাথে কবুল হবে না। অনেকেই বলে থাকেন যে, কুরবানি এবং আকিকা একসাথে দেয়া যায়। কিন্তু এটি হাদিস সম্মত কোনো নিয়ম নয়।

আকিকার পশুর চামড়া

কুরবানির মতো করে আকিকার পশুর চামড়া বাজারে বিক্রি করে গরিব-মিসকিন, দুঃস্থদের মাঝে সেই অর্থ দান করে দিতে হবে। আকিকার চামড়ার টাকা নিজে ভোগ করা উচিত নয়। এলাকায় কোনো গরিব থাকলে তাদেরকে দিতে হবে। কিংবা, কোনো মাদ্রাসায় আকিকার পশুর চামড়া বিক্রির টাকা দিতে পারেন। কুরবানির পশুর চামড়ার মতো করে আকিকায় কুরবানি করা পশুর চামড়ার টাকার উপরে গরিব-মিসকিনের ভাগ রয়েছে। তাই, তাদের ভাগ নিজেরা ভোগ করা যাবে না।

আকিকার কুসংস্কার

আকিকার সঙ্গে আমাদের সমাজে কিছু কুসংস্কার রয়েছে। অনেকেই বলে থাকেন, আকিকার পশু নানা-নানির বাড়ি থেকে দিতে হয়। আদতে আকিকা দেওয়ার নিয়ম এ এমন কোনো রীতির কথা বলা নেই। আকিকা করার সময় সন্তানের পিতা-মাতাকে পশু কিনে কুরবানি করতে হবে। সন্তানের চুল মুণ্ডানোর সময় মাথার তালুর উপর ক্ষুর ধরে রেখে আকিকার পশু জবাই করতে হয় ইত্যাদি কুসংস্কার থেকে দূরে থাকতে হবে। আকিকার অনুষ্ঠানে অনেক সময় গান-বাজনা, নাচ করা হয়ে থাকে। আকিকা করা হয়ে থাকে নবজাতক এর কল্যানের উদ্দেশ্যে। তাই, আকিকার অনুষ্ঠানে এমন কোনো শরিয়ত গর্হিত কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

সন্তানের মাথা মুণ্ডন প্রসঙ্গ

আকিকা দেওয়ার নিয়ম এর মাঝে সন্তানের মাথা মুণ্ডন বা মাথার চুল মুণ্ডন করার কথা বলা আছে। সন্তান জন্মের সপ্তম দিনে সন্তানের কল্যানের উদ্দেশ্যে মাথা মুণ্ডন করতে হবে এবং ছেলেদের আকিকা করার ক্ষেত্রে দুইটি কিংবা একটি পশু কুরবানি করতে হবে এবং মেয়েদের আকিকা করার ক্ষেত্রে একটি পশু কুরবানি করতে হবে। এছাড়াও, আকিকা করার সময় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে। এটি হচ্ছে আকিকা করার সময় সন্তানের ইসলামিক নাম রাখা। সন্তানের ইসলামিক নাম রাখা, মাথা মুণ্ডন করা এবং পশু জবাই করা আকিকার গুরুত্বপূর্ণ ৩টি কাজ।

সন্তানের ইসলামিক নাম রাখা

আকিকা করতে হয় সন্তান এর মঙ্গল এর জন্য। আকিকা করার সময় সন্তানের একটি ইসলামিক নাম রাখতে হবে। ছেলে সন্তান হলে ছেলেদের ইসলামিক নাম রাখতে হবে এবং মেয়ে সন্তান হলে মেয়েদের ইসলামিক নাম রাখতে হবে। সন্তানের ইসলামিক নাম রাখা হলে তার নামের বদৌলতে আল্লাহ্‌ তায়ালা তাকে কবুল করে নিতে পারেন। এছাড়াও, প্রতিটি মুসলিম সন্তানের ইসলামিক নাম রাখা আবশ্যক। আকিকা দেওয়ার নিয়ম ও বিধান এর মাঝে সন্তানের জন্য সুন্দর ইসলামিক নাম রাখা আবশ্যক। সন্তানের ইসলামিক নাম রাখা, মাথা মুণ্ডন করে দেয়া এবং পশু কুরবানি করা আকিকার প্রধান ৩টি কাজ।

সন্তানের কল্যানের উদ্দেশ্যে আকিকা দেয়ার সময় আবশ্যক এই কাজ ৩টি করতে হবে। এছাড়াও আকিকা প্রসঙ্গে প্রচলিত যেসব কুসংস্কার রয়েছে এসবকিছু এড়িয়ে চলতে হবে এবং শরিয়া মোতাবেক আকিকার কাজ সম্পন্ন করতে হবে।

আমাদের শেষ কথা

আজকের এই পোস্টে আপনাদের সাথে আকিকা দেওয়ার নিয়ম ও বিধি-বিধান নিয়ে আলোচনা করেছি। সন্তান জন্ম নিলে সন্তানের পিতা-মাতার শুকরিয়া আদায়ের লক্ষে হালাল পশু কুরবানি করার মাধ্যমে ও একটি ইসলামিক নাম রাখার মাধ্যমে আকিকা সম্পন্ন করতে হয়। আকিকা করার সাথে সন্তানের মাতার চুল মুণ্ডন করে দিতে হবে। পোস্টের মাঝে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। পোস্ট সম্পর্কে আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না। আজকের মতো এখানেই শেষ করছি। আল্লাহ্‌ হাফেয।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন:

Leave a Comment